কাপ্তাই লেকের বুকে জ্বলছে ইতিহাসের শিখা—বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রউফের স্মৃতিসৌধ। দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গ করা এই বীর সেনানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এখন প্রতিদিনই ভিড় করেন সাধারণ মানুষ। শহীদ হওয়া ও সমাধি উভয় স্থান একই জায়গায় হওয়ায় এ স্থানটি হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
দুর্গম এলাকা হওয়ায় একসময় এই স্মৃতিসৌধে মানুষের যাতায়াত ছিল সীমিত। তবে বর্তমানে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং সংরক্ষণের উদ্যোগের ফলে এটি দর্শনার্থীদের কাছে সহজলভ্য হয়েছে।
রাঙামাটি শহর থেকে নৌপথে প্রায় এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত এই স্মৃতিসৌধ। কাপ্তাই লেকের মাঝখানে একটি ছোট টিলা, যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত "রউফ টিলা" নামে। এ স্থানটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। স্মৃতিসৌধের সামনে লেখা রয়েছে, "তুমি দুর্জয় নির্ভীক এক মৃত্যুহীন প্রাণ—হে বীরশ্রেষ্ঠ, তুমি অমর অতন্দ্র প্রহরী।"
এই স্থানে গিয়ে দেখা মেলে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রউফের সমাধি। সমাধির পাশে প্রতীকী একটি উল্টানো এসএমজি স্থাপন করা হয়েছে, যা বীরত্বের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। পর্যটকরা এখানে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সেই অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের কথা স্মরণ করেন।
১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল, পাক সেনাদের একটি বিশাল দল কাপ্তাই লেকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমদিকে সমানতালে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও পরে কৌশলগত কারণে পিছু হটতে বাধ্য হন। এই অবস্থায় মুন্সি আবদুর রউফ একাই একটি মেশিনগান নিয়ে শত্রুদের মোকাবিলা করেন। তার গুলির আঘাতে শত্রুপক্ষের ব্যাপক ক্ষতি হলেও, মর্টার শেলের আঘাতে তিনি শহীদ হন।
মুন্সি আবদুর রউফের এই আত্মত্যাগ তাকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান "বীরশ্রেষ্ঠ" উপাধিতে ভূষিত করেছে। বর্তমানে বিজিবি স্মৃতিসৌধটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছে।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী বলেন, “রাঙামাটির জন্য এটি একটি গর্বের বিষয় যে, দেশের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের একজনের সমাধি এখানে রয়েছে। আমরা এ স্থানে নিয়মিত শ্রদ্ধা জানাই এবং এটির সংরক্ষণে সচেষ্ট থাকি।"
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা জানান, “যদি তারা জীবন উৎসর্গ না করতেন, তবে আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়া সম্ভব হতো না। তাদের এই অবদান কখনো ভোলার নয়।"
বর্তমানে জাতীয় দিবসগুলোতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা এ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, “আমরা চাই মানুষ এখানে এসে তাদের ত্যাগের কথা জানুক। এটি আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য একটি প্রেরণার স্থান।"
রাঙামাটি জেলা পুলিশ সুপার মীর মোদদাছছের হোসেন বলেন, "মুন্সি আবদুর রউফ যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন এবং নিজের জীবন দিয়ে যেভাবে সহযোদ্ধাদের বাঁচিয়েছেন, তা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।"
কাপ্তাই লেকে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে দর্শনার্থীরা এখন সহজেই এই স্থানে আসতে পারছেন। মুন্সি আবদুর রউফের স্মৃতিসৌধ কেবল মুক্তিযুদ্ধের একটি অধ্যায় নয়, এটি চেতনার এক অম্লান মশাল হয়ে জ্বলছে।
মন্তব্য করুন