মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৪ মে ১৯৭১ এক তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এই দিনে মুক্তিযুদ্ধের নানা কার্যক্রমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলোচনার গুরুত্ব বহন করেছে। দিনটির ঘটনাবলি নিম্নে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হলো:
ভারতের লোকসভায় আলোচনা ও ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য
২৪ মে ১৯৭১, ভারতের লোকসভায় বাংলাদেশের প্রসঙ্গে একটি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এই বিতর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এবং পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী সুরেন্দ্রপাল সিং বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
ইন্দিরা গান্ধী তাঁর বক্তব্যে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের কার্যকলাপের নিন্দা করে বলেন, "সমরতন্ত্র বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান নয়, এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সমাধান। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।" তিনি আরও জানান, শরণার্থীদের পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ এবং প্রতিদিন প্রায় ৬০ হাজার শরণার্থী সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করছে। ইন্দিরা গান্ধী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, "বিশ্ব যদি এই সমস্যার সমাধানে কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে ভারতকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।"
ভারতের রেল কর্মচারীরা শরণার্থীদের সহায়তায় একদিনের বেতন দান করার ঘোষণা দেন, যা আনুমানিক ৭০ লাখ টাকা।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম
এই দিনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান কলকাতায় এক বিবৃতিতে বলেন, “যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনে সরকার সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নিয়েছে।” একই সঙ্গে তিনি জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, বাংলাদেশের বিশেষ দূত হিসেবে লন্ডন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রওনা দেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এনামুল হক। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রচার ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে গণহত্যা ও প্রতিরোধ
কর্নেল এম এ জি ওসমানী এই দিনে ভূরুঙ্গামারীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান কার্যালয়ে যান এবং অধিনায়কদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন।
ঝালকাঠি: পাকিস্তানি সেনারা দৈহারীতে ১৭ জন নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে। খাড়াবাগ গ্রামের অঞ্জলি রাণীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।
সিলেট: সুতারকান্দি চেকপোস্টে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানিদের যুদ্ধে ৩৯ পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ২ মুক্তিযোদ্ধা আটক হন।
চাঁদগাজী (চট্টগ্রাম): ক্যাপ্টেন অলির নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণ করে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করে।
ভূরুঙ্গামারী (কুড়িগ্রাম): মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল ওসমানী মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়ান এবং কৌশলগত আলোচনা করেন।
আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা
প্রতিনিধিদল প্রধান ফণীভূষণ মজুমদার, নূরজাহান মুরশিদ এবং শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন দিল্লিতে ভারতের লোকসভা স্পিকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা এবং পাকিস্তানের বর্বরতার বিবরণ তুলে ধরেন। একই সঙ্গে আরব দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার পরিকল্পনা করেন।
স্থানীয় স্তরের শান্তি কমিটির কার্যক্রম
ভোলার প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মোশাররফ হোসেন শাহজাহান আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ঢাকার মগবাজারে শান্তি কমিটির সভায় জি এম খানের সভাপতিত্বে বলা হয়, মুক্তিবাহিনী দেশের শান্তি বিনষ্ট করছে এবং সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে।
সূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি, যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ
পূর্বদেশ ও দৈনিক পাকিস্তান, ২৫ ও ২৬ মে ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ২৫ মে ১৯৭১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র অষ্টম, নবম, দ্বাদশ খণ্ড
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৫ মে ১৯৭১
মন্তব্য করুন