বাংলাদেশের রয়েছে সুদীর্ঘ সমৃদ্ধ ইতিহাস। পর্তুগিজদের আগমন থেকে ব্রিটিশ শাসন, দেশভাগ, এরপর পাকিস্তানি শাসন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। তরুণ প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের সেই পুরো ইতিহাস পৌঁছে দেওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। এটি বাংলাদেশের একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মিত হয় ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ, রাজধানীর সেগুনবাগিচায়। ২০১১ সালে এটি আগারগাঁওয়ে স্থানান্তর করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবন। প্রায় দুই বিঘা জমির ওপর নির্মিত হয়েছে এই ভবন। ভবনের আয়তনের পরিমাণ ১ লাখ ৮৫ হাজার বর্গফুট। ব্যয় হয়েছে ১০২ কোটি টাকা।
আগারগাঁওয়ে নবনির্মিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রবেশমুখেই শোভা পাচ্ছে শিখা চির-অম্লান। মহান মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে প্রজ্বালন করা হয়েছে এই শিখা চির-অম্লান।
নতুন ভবনে রয়েছে ছয়টি গ্যালারি। গ্যালারিগুলো অবস্থিত ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম চলায়। প্রথম গ্যালারিতে শোভা পাচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই জনপদের প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন। দ্বিতীয় গ্যালারিতে রয়েছে ১৯৭১ সালের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় অস্থায়ী সরকার গঠন। ২৫ মার্চের ভয়াবহ গণহত্যা, যার নামকরণ করা হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চ লাইট’, তার বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এই গ্যালারিতে। এমনকি রয়েছে যুদ্ধের সময় লাখো শরণার্থী বাঙালির স্থিরচিত্র। নির্দিষ্ট গ্যালারিতে রয়েছে একটি করে ডিজিটাল স্ক্রিন, যেখানে যুদ্ধের সময়কাল তুলে ধরা হয়েছে।
চতুর্থ গ্যালারিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের বিপক্ষে বাঙালির প্রতিরোধের খণ্ড চিত্র। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে যৌথবাহিনীর অভিযান, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীর যুদ্ধের চিত্র, বুদ্ধিজীবী হত্যা থেকে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় অর্থাৎ পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের নিদর্শন। এ ছাড়া রয়েছে পাঠাগার, যেখান থেকে ভ্রমণকারীরা চাইলেই কিনে নিতে পারেন মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা বই। জাদুঘরে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি বই সংগ্রহে আছে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য কোনো বিশেষ ফান্ড আছে কি না জানতে চাইলে অন্যতম ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য সরকার অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। এ ছাড়া সাধারণ জনগণের কাছ থেকে স্মারক সামগ্রী, আর্থিক অনুদান পাওয়া যায়। সেভাবেই এখানকার ব্যয় মেটানো হয়।
এখানে যেসব মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন রয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার থেকে সংগ্রহ করা। ট্রাস্টিরা ব্যক্তিগত উদ্যোগেও সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন সোর্স থেকে।
বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের যেসব ডকুমেন্ট আছে, সেগুলো আনার কোনো ব্যবস্থা করা হচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নে সারওয়ার আলী বলেন, ‘আমরা যদি কখনো কোনো খোঁজ পাই, চেষ্টা করি যোগাযোগ করতে। কিছুদিন আগেই জানলাম ফ্রান্সের এক ফটোগ্রাফার মুক্তিযুদ্ধের ছবি তুলেছিলেন। আমরা সেখানে যোগাযোগ করছি।’
দেশের অনেকের পক্ষে ঢাকায় এসে এসব নিদর্শন দেখা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে দেশের অন্যান্য জায়গায় এটি সম্প্রসারণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না তরুণ বা শিশুদের জন্য? সারোয়ার আলী বলেন, ‘আমরা প্রত্যেক জেলা শহরে ১৫-২০ দিনের জন্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করি। সে ক্ষেত্রে সেসব এলাকার তরুণ বা শিশুরা প্রদর্শনী দেখতে পারে। আমাদের ভ্রাম্যমাণ গাড়িগুলো (ভ্রাম্যমাণ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর) নিয়ে এক একটা ইউনিট জেলা শহরগুলোতে প্রদর্শনীর দায়িত্বে থাকে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগ্রহ নিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমেও দেখার ব্যবস্থা আছে। সে ক্ষেত্রে তারা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ওয়েবসাইট থেকেই দেখে নিতে পারে।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যেসব দর্শনার্থী আসেন তাদের বেশির ভাগই তরুণ। অনেকে তাদের শিশুদের নিয়েও এখানে আসেন, যাতে সন্তানরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর শুধু মুক্তিযুদ্ধের ধারক ও বাহক নয়, এটি বাংলাদেশ সৃষ্টির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দেয়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম যারা শুধু বইয়ে পড়েছে বাংলাদেশ তথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, তাদের জন্য এটি বিশাল পাওয়া।
মন্তব্য করুন